গন্ত্যব্যঃ "অপরাজেয় বাংলা" শেল্টার হোম, সদর ঘাট।
২৫/০৭/২০১৮
(https://scontent.fdac5-1.fna.fbcdn.net/v/t1.0-9/37818614_882328125288610_2919509581438648320_n.jpg?_nc_cat=0&oh=8bb542070e3e5dfa26710620ec7e6f22&oe=5C0AA3F6)
গত প্রায় তিন মাস আগে আমাদের ভলান্টিয়ার টিম কমলাপুর এবং তার আশে পাশের এলাকা থেকে এমন কিছু সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের সংগ্রহ করে, যাদের নিরাপদ কোন আশ্রয় ছিলো না। খোলা আকাশের নীচে ঘুমায়। স্টেশনে রাতে ঘুমাবার জন্য যখন একটা কোনে গুটিশুটি মেরে শোয় তখন এমন আরো অনেকে এসে তুলে দেয় ৷ এরা সারাদিন পরিশ্রম করে,,দিন শেষে টাকা দিয়ে হয় খাবার খায়, নয়তো নেশা করে। ভোর না হতেই এদের কে পুলিশ মেরে তুলে দেয়, ঘুমাতেও দেয় না।
ভলান্টিয়ার টিমের প্রতিটা মেম্বার ভেতর থেকে অনুভব করে বাচ্চাগুলোর এই অসহায় যাপন। যেহেতু আমরা এইসকল সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়েই কাজ করবো,,তাই অসহায় কয়েকজনকে রেস্কিও করার চিন্তা তাদের মাথায় এক রকম জেকে বসে। একদিন সার্ভে করার পর বিকেলে আমি অফিসে থাকা অবস্থায় তারা আমাকে ফোন করে ।
বলে, "ম্যাম আমরা যদি এখনই এদেরকে রেস্কিও করতে না পারি,,পরে আর এদের পাবো না। আর যদি না পাই, তাহলে কোথায় চলে যাবে, ভালো হবে না মন্দের পাল্লায় পড়বে সেটা জানি না।কিন্তু এই মূহুর্তে এদের রেখে যেতে পারছি না নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকে। আমরা ওদের নিয়ে আসতে চাই".........
তাদের বলাটা সেদিন সহজ ছিল। আবেগটাও। বেশি কিছু চিন্তা করারও সময় ছিলো না তখন। আমি বললাম নিয়ে আসো। নিয়ে আসো বলা টা আমার জন্য সবচেয়ে বিপদজনক ছিলো। আমি জানি না কি হবে, নিয়ে এসে কোথায় রাখবো, কিভাবে রাখবো, কিচ্ছু জানি না, আমার যখন বলা উচিত ছিলো, "না" এখন এদের নিয়ে আসলে আমরা যথাযথ কারনেই এদের রাখতে পারবো না। তখন আমি এক মুহুর্ত না ভেবে বললাম নিয়ে আসো। আমার দিক থেকে সেটা বলা কত টা ঠিক ছিলো জানি না। তবে সেটা সবার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। ছোট রা মিলে একটা টিম ভলান্টিয়ার্স মন কত্ত বড় এক এক জনের। এরা সারাদিন ক্লাস, এসাইনমেন্ট, এক্সাম এসবের পর গিয়ে যখন সার্ভে করে, নিজেদের দায়িত্ব মনে করে সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের খুজে বেড়ায়। যাতে তারা "ড্যাফোডিল ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল সাইন্সেস" এর সাথে যুক্ত হয়ে সুন্দর একটা আগামী পায়। তারা যখন এমন একটি সাহসী পদক্ষেপ নেবার কথা ভাবে, আমি কেন পারছিনা একটা সিদ্ধান্ত দিতে সাহস করে বলে ফেলতে যে "নিয়ে আসো",,, আমি পারছিলাম না তার ও কারন ছিলো। এবং যখন বলেই ফেলেছি তখন ও শঙ্কা আমাকে ঘিরে ছিলো।
যাই হউক ৫ জন শিশুকে শেষ পর্যন্ত আনা হল। এদের প্রত্যেককে নিয়ে আমরা পড়ে গেলাম বিপাক। কোথায় এদের থাকতে দেয়া হবে,আমরা কিছুই জানি না, বোধ হয় প্রথম বার আমার টিমের প্রত্যেক টা মেম্বার সহ আমি অনুভব করলাম,,,আশ্রয়হীন হওয়ার কষ্ট। যাদের কেউ নেই, মাথার উপর ছাদও নেই। তাদের কতটা কষ্ট। এদেরকে দুই দিন রাখা হলো, 'ড্যাফোডিল ফ্যামিলির' ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউজে। পরে একজন স্যারের সহযোগীতায় তাদের পাঠানো হয় সদরঘাটের "অপরাজেয় বাংলা" শেল্টার হোমে। আমার ভলান্টিয়ার টিম গিয়ে মাঝে মাঝে বাচ্চাদের দেখে আসে।আমার টিমের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। দূরত্ব এবং সময় এ দুটোর কঠিন বিড়ম্বনায় আমরা যেতে পারি না সবসময়।
শেষ বার গিয়ে শুনলাম, একজন বাচ্চাকে তার অভিভাবক চাচা এসে নিয়ে গেছে। ছেলেটির মা নেই। বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন। ভাবলাম, যাই হউক সে তার পরিবারের কাছে ফিরে গেছে।
কোন শিশু যদি তার পরিবারের কারো কাছে ফিরে যেতে চায়, সেক্ষেত্রে তাকে আমরা যেতে দিতে বাধ্য। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে। সেখানে গিয়েও সে ভালো নেই। কেন নেই সেটা আমি আলাদা করে প্রত্যেকের কেইস হিস্ট্রি নিয়ে যখন লিখবো তখন বলবো।
আমরা রোজায় ওদের ঈদের পোশাক, খাবার সব দিয়ে এসেছি। আমার কয়েকজন অত্যন্ত দায়িত্বশীল ভলান্টিয়ার ঈদের দিন ও তাদের সাথে কাটিয়েছে। ওরা ভালো ছিলো, কিন্তু প্রতি মুহুর্তেই অপেক্ষা করে থাকে, আমরা কবে যাবো। কবে তাদেরকে আমাদের নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসবো।
আমরা এখনো পারছি না,,,,তবে আশা করছি খুব শীঘ্রই পারবো।
আজ যখন ভিজিটে গেলাম, দেখলাম আরো দুই জন নেই। তাদের ভেতর একজনকে নাকি, মামা এসে নিয়ে গেছে। অন্যজন পালিয়ে গেছে। পালিয়ে গেছে এটাও সত্যি না। ওকে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
আজ "বিজয়" বলছিল, আপু, বেল্ট নাই। আমার জুতাও চুরি হইছে। মন খারাপ হলো। ওকে কিনে দেওয়া জুতাটা চুরি করে নিলো? একটু সংকিত হলাম,,এরা শিখছে কি??
সাথে নিয়ে এসে বেল্ট কিনে দিলাম। পরিবারে থাকলে কিংবা মা থাকলে এভাবেই তো আবদার করতো।
গত তিন মাসে। এই কয়জন আমাদের নিজের আপনের মত হয়ে গেছে। আমাদের প্রতিবারই মনে হয় ছোট ভাইটাকে রেখে আসলাম, মন বিষন্ন হয়। এ প্রফেশনে আবেগ নিয়েই সব কাজ। অথচ আমাদের আবেগ কে নিয়ন্ত্রনে রেখে কর্পোরেট আচারকে সম্ভাষণ জানাতে হয়।
তাদেরকে প্রতিবার কথা দিয়ে আসি, আবার আসবো, এই তো কয় দিন পরেই। ততদিন ভালো করে থেকো,,, মারামারি করো না। খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে যাবো বাকিদের।
আমরা জানি না, মহান আল্লাহ্ কবে আমাদের এই স্বপ্নটা পূরন করবেন। আমরা আশা করে থাকি। বিশ্বাস নিয়ে আছি,,,, স্যারের দেখা স্বপ্ন খুব তাড়াতাড়ি সত্যি হবে। খুব সুন্দর একটা সকাল আসবে। সে সকালেও বৃষ্টি হবে। কিন্তু অসহায় হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে কাউকে ঘুড়ে বেড়াতে হবে না,,, তাদের মাথার উপর থাকবে ছাদ। নির্ভরতার। স্বপ্নগুলো ছিড়ে যাবে না ভিজতে ভিজতে। কেবলই স্নেহে ভিজুক তাদের জীবন,,,,,এইটুকুই তো চাওয়া। খুব খাঁটি চাওয়া...