(https://www.banglanews24.com/public/uploads/2020/07/15/ttttaaa20200715220442.jpg)
সন্তান কিভাবে ভালো মানুষ হবে, সেক্ষেত্রে পিতা-মাতার দায়িত্ব
যতদিন পর্যন্ত সন্তানের জ্ঞান বুদ্ধি পরিপক্ক না হয়, ততদিন পর্যন্ত তাদেরকে শাসন করা এবং কঠোরতার মধ্যে রাখার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু যখন সন্তান জ্ঞান বুদ্ধিতে পরিপক্ক হয় এবং ভালো মন্দ বুঝতে পারে, যুক্তি ও জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে কাজকর্ম করতে পারে তখন যদি কোন বাবা মা কঠোরতা করতে যায় তবে সেই সন্তান নিজের সম্মান নিজেই নষ্ট করবে এবং পিতা-মাতার সাথেও তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। যা বর্তমান সময়ে অহরহ আমাদের সামনে ঘটেই চলছে। এই জন্যে সন্তান ছোট থাকতেই তাকে যতদূর সম্ভব কঠোরতা আর শাসন করা প্রয়োজন।
খুবই দুঃখ লাগে যখন এমন অনেক পিতা-মাতাকে দেখি যারা দুনিয়ার কাজ-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু সন্তানের ব্যাপারে অত্যন্ত বেখেয়াল। এটা ভাবতে থাকে যে, সন্তান যখন বড় হবে তখন হয়তো সব শিখে যাবে। কিন্তু না। সন্তানকে শেখানোর দায়িত্ব পিতা-মাতার। আর সেটা ছোট বেলা থেকেই। কারণ পিতা-মাতাই তার শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়। আবার অনেকে আছে তারা অন্যের কাছে অনেক উত্তম চরিত্র পেশ করে এবং মানুষকে ভালো পরামর্শ দেয়। কিন্তু নিজের পরিবারের ক্ষেত্রে তারা এই সকল জিনিস ভুলে যায়। কিভাবে নিজের সন্তানদেরকে ভালো উপদেশ দিতে হবে, কিভাবে তাদেরকে সঠিক পথে আনতে হবে, তাদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে আর কিভাবে সন্তানের আবদার পূরণ করতে হয় সেটা পর্যন্ত ভুলে যায়। যা কিনা অত্যন্ত মর্মন্তুদ ব্যাপার। ইসলাম ধর্মে সন্তান আর স্ত্রীর ব্যাপাওে অত্যন্ত কঠোর পরিস্থিতির কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে- পরিবার-পরিজনের হক আদায়ের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। অথচ এসব চিন্তা-ভাবনা আমাদের মাথা থেকেই উধাও হয়ে যায়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার পিতা-মাতারা নিজেরা বা নিজেদের জন্যে যা ভালো মনে করেন সেটাই নিজেদের সন্তানদের উপর প্রয়োগ করতে চান। তারা নিজের সন্তানের পরিস্থিতি একটুও বুঝবার চেষ্টা করেন না। তারা এটা জানার চেষ্টা করেন না যে, পৃথিবী এখন কতটা এগিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে পুরো পৃথিবী যেই দিক থেকে এগিয়ে গিয়েছে এবং সকল মিডিয়াতেও এর প্রচারণা হচ্ছে, তা হচ্ছে ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’। আল্লাহ্ তা’আলাও মানুষকে নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দিয়েছেন। পিতা-মাতা যদি পরিবারের ক্ষেত্রে দ্বীন দুনিয়ার খবর না রেখে নিজের ইচ্ছাকে সন্তানের উপর চাপিয়ে দিতে চান তাহলে এর পরিণাম হয় খুবই খারাপ। এতে সেই সন্তানের জীবনটাই নষ্ট হয় শুধুমাত্র এই পিতা-মাতার কারণে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলছেন, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি, যে নিজের পরিবারের কাছে ভালো। (তিরমিজি, হাঃ ৩৮৯৫)
আল্লাহর রাসুল (সা.) এর এই কথাটি সবসময় মনে রেখে চলবেন- সবার আগে নিজের পরিবারের বিশেষ করে সন্তানের মানসিক পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করবেন এবং সেই অনুযায়ী আহবান জানাবেন। আপনার উচিৎ ভালো কাজের আহবান পৌঁছে দেওয়া, জোর জবরদস্তি করা নয়। যদি আপনার কথা সঠিক হয় তবে আপনার সন্তানকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলুন। কিন্তু জোর করার অধিকার আপনার নেই। কারণ জোর করা যায় পশুর সাথে, মানুষের সাথে নয়।
প্রিয় ভায়েরা এবং বোনেরা, এবার আসি একটু গোড়ার কথায়। সন্তান গর্ভে যাওয়ার সাথে সাথে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করুন। আব্দুল কাদির জিলানীর ঘটনা পড়ুন। কেন আব্দুল কাদির জিলানীর পিতা-মাতার মধ্যে শিক্ষা রয়েছে তা জানুন। অনেক শিক্ষা রয়েছে। ইসলাম-ই শান্তি। বাকি সব অশান্তি। সন্তান যখন গর্ভে পিতা এবং মাতা দুজনেই সকল অন্যায় কাজ করা ছেড়ে দিন। বেশি বেশি আল্লাহকে ডাকতে থাকুন। মনে রাখবেন ওই সন্তান-ই আপনার সাদকায়ে যারিয়া। আবার ওই সন্তান-ই আপনার জাহান্নামে যাওয়ার হাতিয়ার। সন্তান জন্মের সাথে সাথে কিছু হক রয়েছে। সেগুলো যথাযথ ভাবে পালন করুন। বড় হতে হতে আল্লাহর বিধান সমূহ পালনের ব্যাপারে তাকে জানান। এই ক্ষেত্রে ইবরাহীম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ) এর কথোপকথন বার বার মনে রাখুন। সন্তানকে একবার ভালো কথা বলেই মনে করবেন না যে, আপনি সব কাজ সেরে ফেলেছেন। আসলে আপনার কাজ তো শুরু মাত্র। আপনি পিতা, আপনি মাতা, আপনি অভিভাবক। আল্লাহর সাহায্য বার বার প্রত্যাশা করুন। মেয়ে সন্তান হলে ছোট থেকেই পর্দা করার ব্যবস্থা করুন। সন্তান আপনার, আর আপনি যদি বলেন, ওরে এত বলি তা শোনে না। এই কথার মাধ্যমে আপনার মাতৃত্ব ও পিতৃত্ব এর দায় আপনি কখনোই এড়াতে পারবেন না। কারণ ছোট বেলাতেই যদি সে আপনার কথা না শোনে নিশ্চিতভাবে বড় হলে আর শুনবেই না বরং বিগড়ে যাবে। বার বার বলছি, আপনার সন্তানকে আদব-কায়দা শেখাতে কখনোই আজ থাক, কাল ঠিক হয়ে যাবে- এমন প্রত্যাশা কখনোই করবেন না।
আপনার পরিবারকে আপনি নিজের কাছে টেনে নিন। সে তো আপনার সন্তান। আপনার কথা তারা যদি না শুনতে চায় তবে কার কথা শুনবে.?? তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা নিজেরা অর্থাৎ পিতা-মাতারা ভালো হওয়ার চেয়ে সন্তানদেরকে ভালো বানানোর বেশি চেষ্টা করি। যা কি না আদৌ সম্ভব নয়। কারণ আপনার সন্তান আপনাকে ২৪ ঘন্টা চোখে চোখে রাখে। আপনি কি করেন, কিভাবে অন্যের সাথে কথা বলেন, আপনি কিভাবে রাগকে হজম করেন, কিভাবে আপনি মানুষকে আপন করে নেন, মানুষের সাথে কিভাবে ব্যবহার করেন- সব, সবকিছু। তাহলে আপনি কতটুকু সিরিয়াস হবেন আপনার আচরণের ক্ষেত্রে, এবার সেটা নিশ্চই আপনাকে আর বোঝানো লাগবে না।
একটি কথা শুনুন, সন্তান কথা না শুনতে পারে। তাকে বার বার বিভিন্ন পদ্ধতিতে বোঝানোর চেষ্টা করুন। তবে হ্যাঁ, অবশ্যই, অবশ্যই, তাকে দূরে সরিয়ে দিবেন না। এটা সত্যি খুবই দুঃখজনক যে কিছু পুরুষ-মহিলা সমাজের মানুষের সাথে খুব ভালো আচরণ দেখায় আর খুব সুন্দর চরিত্র ফুটিয়ে রাখে কিন্তু নিজের পরিবারের সাথে জঘন্য-নোংরা আচরণ করেন। তাদের মুখের কথায় কথায় গালি বের হয় আর কিছু থেকে কিছু হলেই তারা স্ত্রী সন্তানের গায়ে হাত তুলতেও পিছু হটেন না। তারা মনে করেন আল্লাহ তাদেরকে দারোগা করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। আর তারা মনে করে এইভাবে শাসন করে সে ভালো কাজ করছে। কিন্তু, না প্রিয় ভাই এবং বোনেরা। আপনার কাজ ভালো কথাগুলো আপনার পরিবারের মধ্যে বলা আর আপনার নিজেকেও সেই মতাদর্শ অনুযায়ী গড়ে তোলা। জুলুম করা আপনার কাজ নয়।
মনে রাখবেন আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ (সা.) কে পর্যন্ত একথা বলেছেন যে, ‘হে রাসূল! আপনি তাদেরকে উপদেশ দিন, আপনি কেবল উপদেশদাতা, আপনাকে দারোগা বানিয়ে পাঠানো হয়নি যে আপনি তাদের বাধ্য করবেন।’ (সূরা আল-গাশিয়াহ, আয়াত: ২১-২২)
খুব খেয়াল করে শুনে রাখুন প্রিয় ভাই এবং বোনেরা, যদি আপনার পরিবার আপনার নম্রতা আর ভালো আচরণের সাক্ষী না দেয় তাহলে আপনার নামায, যাকাত, হজ্জ, রোজা, দান-সাদকাহ সবই বাতিল হয়ে যাবে। এই ব্যাপারে রাসুল (সা.) এর কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো এক মহিলার ব্যপারে, যে কিনা খুব ইবাদাত করতো কিন্তু প্রতিবেশীর সাথে মন্দ আচরণ করতো। তার ফলাফল রাসুল (সা.) বলেছেন- সে জাহান্নামে যাবে।
তাই বলছি প্রিয় ভায়েরা আর বোনেরা, আপনার সন্তানকে যদি সবচেয়ে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চান তবে প্রথমেই সবচাইতে বড় পরীক্ষা হচ্ছে আপনার চরিত্র সুন্দর রাখা। আর আপনার চরিত্রের সুন্দর আচরণ সবার আগে আপনার পরিবারের সাথে ফুটে উঠবে। আপনার পরিবারের স্ত্রী-সন্তান যদি আপনার চরিত্রের সাক্ষী হয়ে উঠতে পারে তবেই আপনার সন্তান আপনার শাসন ছাড়াই ভালো সন্তানে পরিণত হবে। নতুবা এই সন্তানের জন্যেই পরকালে আপনার কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
সুতরাং শেষ কথা হচ্ছে, আল্লাহকে ভয় করুন। সন্তানের জন্যে রাতে জেগে উঠুন, দোআ করুন। পরিবারের জন্যে বেশি বেশি দোআ করুন। আর হক কথা আর হক কাজ নিজেও মেনে চলুন, সন্তানকেও সুন্দর আচরণের মাধ্যমে বুঝিয়ে বলুন। নিজের বিরুদ্ধে গেলেও সত্য কিন্তু সবসময় সত্য। আল্লাহ বান্দাকে যেই হক দিয়েছেন সেটা আপনি ছিনিয়ে নেওয়ার কোন অধিকার রাখেন না। সেটা আপনার লাভ হোক আর লোকসান হোক, আপনাকে মেনে নিতেই হবে। আল্লাহ আমাদের বুঝার তৌফিক দান করুন। আমিন। আর হক কথা আর হক কাজ নিজেও মেনে চলুন, সন্তানকেও সুন্দর আচরণের মাধ্যমে বুঝিয়ে বলুন। নিজের বিরুদ্ধে গেলেও সত্য কিন্তু সবসময় সত্য।
প্রিয় ভাই এবং বোনেরা, পরিশেষে আপনাকে একটা পরামর্শ দেই, আল্লাহর সাথে এমনভাবে কথা বলুন যেন তিনি আপনার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। আপনি যখন আশ্চর্যজনক কিছু দেখেন, যদিও আল্লাহ তা জানেন তবুও তা চুপচাপ আল্লাহর কাছে উল্লেখ করুন। আপনি যখন কাজ থেকে বাড়ি ফিরছেন, বিশ্রাম নিতে নিতে তাকে আপনার সারা দিনের কথা বলুন। আপনি যখন বিছানায় শুয়ে থাকবেন তখন পরের দিনের জন্য আপনার পরিকল্পনা সম্পর্কে আল্লাহকে বলুন। আপনি যে স্বপ্ন দেখেছেন তা সম্পর্কে আল্লাহকে বলুন। যখন আপনি ক্লান্ত তখন আপনার ক্লান্তির কথা আল্লাহকে বলুন। শুধু আল্লাহর সাথে কথা বলুন। ফলে আপনি তার নিকটবর্তী হবেন এবং দোআ করা সহজ হবে। তবে একটি কথা সর্বদাই মনে রাখবেন- সুখ-দুঃখ উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহকে স্মরণ করুন। দেখবেন আল্লাহ আপনাকে আরো কাছে টেনে নিবেন। আল্লাহ আমাদের সব্বাইকে কবুল করুন। আমীন!