অনেক অনেক বছর আগের কথা। তখন রোম দেশের তয়তুস শহরে দাকিয়ানুস নামে এক অত্যাচারী শাসক ছিল। সময়টা ছিল ঈসা (আঃ)-এর আগমনের কিছুকাল পরের। দাকিয়ানুস ছিল একজন মূর্তিপূজক। এক আল্লাহর প্রতি ইমানদার কাউকে পেলেই সে চরম নির্যাতন করত; এমনকি হত্যাও করত!
কয়েকজন সাহসী যুবক দাকিয়ানুসের এমন অত্যাচারের তীব্র বিরোধিতা করে জনগণের মাঝে দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকে।
যুবকদের কথা দাকিয়ানুসের কানে যায়। এতে সে ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে যুবকদের নিকট খবর পাঠায়-'হয় তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ছাড়বে, নাহয় আমি তোমাদের হত্যা করব।'
যুবকরা এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনায় অটল থাকে এবং লোকালয় থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করে।
যুবকরা চুপি চুপি লোকালয় থেকে পালিয়ে গিয়ে পাহাড়ের একটি বিশাল গুহায় আশ্রয় নেয়। তাদের পিছু পিছু একটি কুকুরও আসে। কুকুরটিও তাদের সাথে গুহায় আশ্রয় নেয়।
এদিকে যুবকদের পালিয়ে যাওয়ার কথা জেনে দাকিয়ানুস তাদের ধরার জন্য একদল সৈন্য পাঠায়। সৈন্যরা অনেক চেষ্টা করেও তাদেরকে আর খুঁজে পায়নি।
গুহায় আশ্রয় নেওয়া যুবকরা ছিলেন সাতজন। সাথে ওই কুকুরটিও ছিল। আল্লাহ তায়ালা কুকুরসহ তাদের সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে দেন।
গুহার মুখে ঘুমিয়ে ছিল কুকুরটি, দেখে মনে হতো- সে যুবকদের পাহাড়া দিচ্ছে। ভয়ে কেউ গুহায় ঢোকার সাহস পেত না। লোকেরা মতে করত, সফররত কোনো কাফেলা এখানে অবস্থান করছে হয়তো। গুহায় মুখ এমন জায়গায় ছিল যে তাতে কখনো রোদের উত্তাপ লাগত না। এজন্য গুহাটি সব সময় আরামদায়ক ছিল।
যুবকরা ঘুমিয়ে গেল। দিন গিয়ে মাস গড়াল। এক মাস-দুই মাস করে বছর শেষ হলো, তবুও তারা ঘুমিয়ে রইল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কেটে গেল বছরের পর বছর। যুগের পর যুগও চলে গেল। একশত বছর শেষ হলো। দুইশত বছর শেষ হলো। তবু তারা ঘুমিয়ে রইল। কী আশ্চর্য! তখনও তারা জীবিত। ঘুমের মধ্যেই এপাশ ওপাশ করছে, কিন্তু ঘুম ভাঙছে না। শেষ পর্যন্ত তিনশত বছর গত হলো। এবার! এবার তারা জেগে উঠল। কুকুরটিও জেগে গেল। কিন্তু কী আশ্চর্য! তারা ঠিক আগের মতোই ছিল।
যুবকরা একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করতে লাগল-' আমরা কতক্ষণ ধরে এখানে ঘুমিয়ে ছিলাম? তখন তারা নিজেরাই বলাবলি করতে লাগল-'আল্লাহই ভালো জানেন, আসলে আমরা কতদিন ঘুমিয়ে ছিলাম। তবে মনে হয় একদিন বা তার চেয়েও কম সময় এখানে ঘুমিয়ে ছিলাম।'
তাদের খুব খিদে পেল। তাদের কাছে কিছু টাকা ছিল। সেই টাকা থেকে খাবার কেনার জন্য একজনকে বাজারে পাঠাল।
যুবকরা ভেবেছিল-এখনও দাকিয়ানুসের সময়কাল চলছে। এজন্য তারা খুব ভয়ে ভয়ে ছিল। ভাবল, রাজা জানতে পারলে যেকোনো সময় তাদের পাথর মেরে হত্যা করে ফেলবে অথবা তাদের ধর্মে ফিরিয়ে নেবে। তাই যুবকটিকে তারা খুব সাবধানে, কেউ যেন টের না পায়- এমনভাবে বাজারে গিয়ে কিছু খাবার কিনে আনতে বলল।
বাজারে গিয়ে যুবকটির সবকিছু অচিন মনে হলো। তারপরও সে খাবার কিনল। যেই সে দোকানদারকে মুদ্রা দিলো, দোকানদার অবাক হয়ে বলল-'এ মুদ্রা তুমি কোথায় পেলে? এ তো বহু আগের মুদ্রা, শত শত বছরের পুরোনো মুদ্রা! নিশ্চয় তুমি গুপ্তধন পেয়েছ!'
যুবক বলল-'অসম্ভব! এ আমার নিজের মুদ্রা। দু-তিন দিন আগেই তো আমি এ মুদ্রা দিয়ে কেনাকাটা করেছি। তুমি কী আজগুবি কথা বলছ?' দেখতে দেখতে সেখানে ভিড় জমে গেল।
সবাই যখন বলল- এটি বহু পুরোনো দিনের মুদ্রা, যুবকটি যখন জানল দাকিয়ানুস নেই, সে কয়েকশত বছর আগেই গত হয়েছে। তখন সে তাদের কাহিনি শুনিয়ে বলল-'আমার সঙ্গী্রা খাবার নিতে পাঠিয়েছেন, তাঁরা এখন গুহায় আছেন। তোমাদের বিশ্বাস না হলে আমার সাথে সেই গুহায় চলো, সেখানে তাদের দেখতে পাবে।'
লোকেরা এ খবর তখনকার বাদশাহকে জানায়। বাদশাহর নাম ছিল বায়জুসিস। তিনি ছিলেন একজন সৎ, ইমানদার ও ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ। তিনি ঘটনা শুনে খুবই অবাক হন। সাথে সাথে তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনী ও দলবলসহ গুহার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
এদিকে গুহায় থাকা যুবকরা ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনে মনে করল, দাকিয়ানুস হয়তো তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে আমাদেরকে ধরতে আসছে। যুবকরা তখন তাড়াতাড়ি নামাজে দাঁড়িয়ে যান।
বাদশাহ বায়জুসিস তাদের নামাজ পড়তে দেখে অপেক্ষা করতে থাকেন। গুহাবাসীরা নামাজ পড়া শেষ করলে বাদশাহ তাদের সালাম দেন।
গুহাবাসীরা খুব অবাক হয়ে যান। দেখে- এ তো দাকিয়ানুস নয়; অন্য কোনো বাদশাহ! বাদশাহ বায়জুসিস তাঁর পরিচয় দেন।
এবার যুবকরা তাদের কাহিনি শোনান। বাদশাহ তখন তাদের জানান, অত্যাচারী দাকিয়ানুস কয়েকশত বছর আগেই মারা যায়। এখন এ দেশের অধিকাংশ লোকই ঈমানদার। যুবকরা ভীষণ খুশি হন। কৃতজ্ঞতায় আল্লাহর দরবারে সিজদায়ে লুটিয়ে পড়েন।
কিছুক্ষণের মধ্যে গুহাবাসী এ আশ্চর্য যুবকদের প্রবল ঘুম আসতে থাকে। তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েন। এ ঘুমের মাধ্যমেই আল্লাহ তায়ালা তাদের মৃত্যু ঘটান।
এভাবেই আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির সামনে এক অনুপম নিদর্শন দেখালেন। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা সবকিছুই করতে পারেন; তিনি সর্বশক্তিমান।
তোমরা এ ঘটনা সূরা আল কাহাফের ৯ থেকে ২৬ নম্বর আয়াতে পাবে। এ ঘটনার জন্যই এ সূরার নাম রাখা হয় আল কাহাফ বা গুহা।
যখন যুবকরা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয়গ্রহণ করে তখন দোআ করেঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে নিজের কাছ থেকে রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্যে আমাদের কাজ সঠিকভাবে পূর্ণ করুন।
আপনার কাছে তাদের ইতিবৃত্তান্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। তারা ছিল কয়েকজন যুবক। তারা তাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
আমি তাদের মন দৃঢ় করেছিলাম, যখন তারা উঠে দাঁড়িয়েছিল। অতঃপর তারা বললঃ আমাদের পালনকর্তা আসমান ও যমীনের পালনকর্তা আমরা কখনও তার পরিবর্তে অন্য কোন উপাস্যকে আহবান করব না। যদি করি, তবে তা অত্যন্ত গর্হিত কাজ হবে।
এরা আমাদেরই স্ব-জাতি, এরা তাঁর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে। তারা এদের সম্পর্কে প্রকাশ্য প্রমাণ উপস্থিত করে না কেন? যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, তার চাইতে অধিক গোনাহগার আর কে?
তোমরা যখন তাদের থেকে পৃথক হলে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের এবাদত করে তাদের থেকে, তখন তোমরা গুহায় আশ্রয়গ্রহণ কর। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের জন্যে দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ কর্মকে ফলপ্রসু করার ব্যবস্থা করবেন।
তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডান দিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বামদিকে চলে যায়, অথচ তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত। এটা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম। আল্লাহ যাকে সৎপথে চালান, সেই সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, আপনি কখনও তার জন্যে পথপ্রদর্শনকারী ও সাহায্যকারী পাবেন না।
তুমি মনে করবে তারা জাগ্রত, অথচ তারা নিদ্রিত। আমি তাদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাই ডান দিকে ও বাম দিকে। তাদের কুকুর ছিল সামনের পা দুটি গুহাদ্বারে প্রসারিত করে। যদি তুমি উঁকি দিয়ে তাদেরকে দেখতে, তবে পেছন ফিরে পলায়ন করতে এবং তাদের ভয়ে আতংক গ্রস্ত হয়ে পড়তে।
আমি এমনি ভাবে তাদেরকে জাগ্রত করলাম, যাতে তারা পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের একজন বললঃ তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ? তাদের কেউ বললঃ একদিন অথবা একদিনের কিছু অংশ অবস্থান করছি। কেউ কেউ বললঃ তোমাদের পালনকর্তাই ভাল জানেন তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ। এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ শহরে প্রেরণ কর; সে যেন দেখে কোন খাদ্য পবিত্র। অতঃপর তা থেকে যেন কিছু খাদ্য নিয়ে আসে তোমাদের জন্য; সে যেন নম্রতা সহকারে যায় ও কিছুতেই যেন তোমাদের খবর কাউকে না জানায়।
এমনিভাবে আমি তাদের খবর প্রকাশ করে দিলাম, যাতে তারা জ্ঞাত হয় যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কেয়ামতে কোন সন্দেহ নেই। যখন তারা নিজেদের কর্তব্য বিষয়ে পরস্পর বিতর্ক করছিল, তখন তারা বললঃ তাদের উপর সৌধ নির্মাণ কর। তাদের পালনকর্তা তাদের বিষয়ে ভাল জানেন। তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হল, তারা বললঃ আমরা অবশ্যই তাদের স্থানে মসজিদ নির্মান করব।
অজ্ঞাত বিষয়ে অনুমানের উপর ভিত্তি করে এখন তারা বলবেঃ তারা ছিল তিন জন; তাদের চতুর্থটি তাদের কুকুর। একথাও বলবে; তারা পাঁচ জন। তাদের ছষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর। আরও বলবেঃ তারা ছিল সাত জন। তাদের অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর। বলুনঃ আমার পালনকর্তা তাদের সংখ্যা ভাল জানেন। তাদের খবর অল্প লোকই জানে। সাধারণ আলোচনা ছাড়া আপনি তাদের সম্পর্কে বিতর্ক করবেন না এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে তাদের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ ও করবেন না।
'আল্লাহ ইচ্ছা করলে' বলা ব্যতিরেকে। যখন ভুলে যান, তখন আপনার পালনকর্তাকে স্মরণ করুন এবং বলুনঃ আশা করি আমার পালনকর্তা আমাকে এর চাইতেও নিকটতম সত্যের পথ নির্দেশ করবেন।
বলুনঃ তারা কতকাল অবস্থান করেছে, তা আল্লাহই ভাল জানেন। নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলের অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই কাছে রয়েছে। তিনি কত চমৎকার দেখেন ও শোনেন। তিনি ব্যতীত তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। তিনি কাউকে নিজ কর্তৃত্বে শরীক করেন না। (সূরা আল কাহাফের ৯ থেকে ২৬ নম্বর আয়াত)