« on: August 29, 2018, 02:24:00 AM »
একজন সাহসী মায়ের গল্প
নামঃ ফারজানা নাজনীন ঝর্ণা
বয়সঃ ৩৮ বছর
পেশাঃ গৃহিনী
"নাজনীন" একজন অপরাজেয় সাহসী 'মা'। পৃথিবীর সকল মায়েরাই অপরাজেয়। অদম্য। তবুও কারো কারো সংগ্রাম চোখে পড়ার মত। বিয়ের পর প্রথম সন্তানের জন্য অপেক্ষা প্রতিটা দম্পতির কাছে অধীর আগ্রহের এবং অসীম ধৈর্যের বিষয়। নাজনীন-কামরুল দম্পতির প্রথম সন্তান পৃথিবীতে যখন এলো ঠিক তখনো তাদের জানা নেই, নিয়তি কতটা নির্মম রুপ ধারন করে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সন্তান জন্মের ঠিক ছয় থেকে সাত মাস পরেও যখন আরো দশজন বাচ্চার মত তাদের প্রথম বাচ্চাটি স্বাভাবিক আচরন করছিলো না, তখন মায়ের মনে এক আশংকার জন্ম নেয়। ডাক্তার দেখিয়ে উনারা নিশ্চিত হন যে তাদের প্রথম বাচ্চাটি "স্পেশাল চাইল্ড" অটিজমে আক্রান্ত। মায়ের সংগ্রাম শুরু হয় সেখান থেকে সেদিন থেকেই। মেয়েটা বড় হতে থাকে। স্বাভাবিক আচার আচরন বলতে যা বুঝায় সেটা একজন স্পেশাল চাইল্ড বা প্রতিবন্ধী বাচ্চার কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। তবুও 'মা' অপেক্ষা করে থাকেন প্রতিটা সকাল, কোন না কোন একদিন মেয়েটা 'মা ডেকে ফেলবে। হয়তো তার কাছে নিজের ভাষায় কিছু আবদার করবে। জগতে এই আকুতি কাছে অন্য যে কোন আকুতি হার মানে। দিন কেটে যায় কিন্তু প্রতিক্ষার অবসান হয় না। মেয়েটার কোন স্বাভাবিকতা চোখে পড়ে না অভিবাবকদের। এভাবেই কাটে আরো সাত বছর। এই সাত বছরে নাজনীন "মা" ডাক শুনতে পান নি। অথচ তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী একজন মা। প্রথম বাচ্চা জন্মের ঠিক সাত বছর পর নাজনীন আবার সন্তানসম্ভবা হন। জানতে পারেন, জমজ কন্যার জন্ম দিতে যাচ্ছেন। একদিকে খুশি, আর অন্য দিকে ভয় তাকে ঘিরেই থাকে। সৃষ্টিকর্তার কাছে তার একটাই চাওয়া তখন, যেন তিনি সুস্থবাচ্চার জন্ম দিতে পারেন। যথাসময়ে ফুটফুটে দুটো মেয়ের জন্ম হলো। স্বাভাবিক, সুন্দর, পবিত্র মুখ। বাচ্চারা ফেরেশতাতুল্য। প্রথম বাচ্চাটির মুখ থেকে 'মা' ডাক শুনতে না পারার যে কষ্ট সেটা হয়তো কখনো পুরোপুরি দমে যাবে না, কিন্তু নতুন আশা উঁকি দেয়। এই দুই শিশুর মুখে তো "মা", ডাক শোনা হবে, যদি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা হয়। সব সহজ স্বাভাবিক চলতে থাকে। দু' তিন বার ডাক্তারের কাছে বাচ্চাদের রুটিন চেক-আপের জন্য নেওয়া হয়। ডাক্তার বলেন সব ঠিকই আছে এবং বাচ্চাগুলো স্বাভাবিক। ভয়ের কারন নেই। এই দুজন শিশুর আগের বাচ্চাটির মত স্পেশাল চাইল্ড হবার সম্ভাবনা নেই। এর ঠিক মাস তিনেক পর নাজনীন দম্পতির সন্দেহ হতে থাকে। বাচ্চারা স্বাভাবিক নয় বলে তাদের মনে হতে থাকে। জন্মের এক বছর পরও বাচ্চারা সামান্য শব্দ বাদে অন্য কোন বিশেষ শব্দই ব্যবহার করছে না এবং যেহেতু এ বিষয়ে উনাদের পূর্বাভিজ্ঞতা রয়েছে তা থেকে উনি আবারও ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন। পরীক্ষা নিরিক্ষায় জানা গেলো,,, এই দুই জন জমজ সন্তানও আগের জনের মতই অটিস্টিক বা স্পেশাল চাইন্ড এক কথায় শারিরীক এবং মানসিক প্রতিবন্ধী। আকাশ মাথায় ভেঙে পরলে কেমন অনুভূতি হবে তা কারো জানা নেই। তাদের মনের অবস্থা তখন কেমন হয়েছিল যখন তারা আরো একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হলেন, তা একমাত্র আল্লাহ্ই জানেন।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে।
উনার প্রথম কন্যার বয়স এখন ১৪ বছর।
নামঃ হৃদি।
পরের দুইজন জমজ কন্যার বয়স ৭ বছর,
কি সুন্দর দেখতে কি ফুটফুটে বাচ্চা গুলো।
নামঃ রথি ও হৃথি।
তিনজন সন্তানের মা হবার পরও একবারের জন্যও ''মা" ডাক শুনতে না পারার যে কষ্ট, এটা সেই মা ব্যতীত জগতের অন্য আর কারো পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কখনোই না।
আমি নিজে গিয়ে দেখেছি, মহিলা কি পরিমান অসীম সাহসিকতায় তিন তিন জন অটিস্টিক বাচ্চার সম্পূর্ন লালন পালন করছেন। কতখানি ধৈর্য থাকলে এটা সম্ভব তা আমাদের মত সাধারনের পক্ষে উপলব্ধি করা অসম্ভব। প্রথম যেদিন আমি উনার বাসা থেকে ঘুরে এলাম, সাথে মিডিয়া ল্যাবের "মৌ" আপু। আমরা উনার এই সাহসী এবং সংগ্রামী ভূমিকার উপর একটি ছোট্ট ডকুমেন্টারি তৈরির কাজে গিয়েছিলাম। সেদিন ফেরার সময় নিজেকে খুব ই তুচ্ছ মনে হচ্ছিল, সামান্য কষ্টেই আমরা কত কাতর হয়ে যাই। অথচ এই মহিলা, জগতের সকল কষ্টই একা ধারন করে বসে আছেন।
আমরা তার ধৈর্যের কাছে মাথা নত করি।
তার সংগ্রামকে আমরা সালাম জানাই।
তার সাহস এবং অভিজ্ঞতাকে আমরা সম্মান করি।
সৃষ্টিকর্তা কোন একদিন নিশ্চই তার মনের আকুতি শুনবেন। নাজনীন তার সন্তানদের কাছ থেকে অবশ্যই একদিন "মা" ডাক শুনতে পারবেন। তার সন্তানেরা আবদার করে একটি খেলনা হলেও দেখিয়ে বলবে এটা তাদের চাই..... আমরা সেই প্রর্থনা করি।
আশার বিষয় হচ্ছে, এমন একজন সাহসী মায়ের সাহসিকতা এবং অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে ড্যাফোডিল পরিবারের সম্মানিত চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সবুর খান স্যার মিস নাজনীনকে উনার নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে " থ্রি স্টার স্পেশাল স্কুল" (যেখানে অটিস্টিক বাচ্চারা শিক্ষা সুবিধা সহ অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্ত হবে) নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার যাবতীয় অর্থ সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছেন।
তারই ফলশ্রুতিতে গত পরশুদিন মিস নাজনীনের হাতে "ড্যাফোডিল ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল সাইন্সেসেস" এর পক্ষ থেকে তার স্কুলের দুই মাসের ভাড়া বাবদ নির্ধারিত পরিমান অর্থের চেক প্রদান করেন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির সম্মানিত কোষাধ্যক্ষ জনাব হামিদুল হক খান স্যার।
খুব শীঘ্রই আমরা নাজনীন ঝর্নার স্পেশাল স্কুলের সচিত্র প্রতিবেদন আপনাদের সামনে নিয়ে আসবো ইনশাআল্লাহ! আমরা আশাবাদী একজন সফল, সংগ্রামী মা একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
(প্রতিবেদন তৈরিতেঃ Farhana Haque)
« Last Edit: August 29, 2018, 04:19:15 AM by Farhana Haque »
Logged
কারো মত নয় আমরা হবো যার যার মত। প্রতিজন "আমি" হবো এক একটি আদর্শ। জীবন একটিই। সময় অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। নিজেকে প্রমান করার এবং ভালো কাজ করার এখনই সময়।