« on: September 23, 2022, 12:14:03 AM »
ইনসাফ ভিত্তিক কর্মবণ্টন ও শরীয়ত অনুযায়ী আমলের গুরুত্ব
বর্তমান যামানায় প্রায় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানই কর্মীদের এবং লিডারদের মাঝে সম্পর্কের ঘাটতি, ঈর্ষাকাতরতা এবং অবিশ্বাসের পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়। এর একটি কারণ যেমন, পৃথিবীতে আল্লাহর ভয় কমে যাচ্ছে। ঠিক তেমনিভাবে এর একটি বড় কারণ, পরামর্শের মাধ্যমে কার্য বণ্টন এবং কর্মপন্থা নির্ধারণ না করা বলে আমি মনে করি।
রাসূল (সা.)এর একটি অভ্যাস ছিল যে, সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করে প্রত্যেকের অবস্থা ও সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ বণ্টন করতেন এবং নিজের যিম্মায়ও কিছু কাজ নিতেন।
প্রসিদ্ধ আছে যে, এক সফরে রাসূল (সা.) লাকড়ি কুড়ানোর কাজ নিজের যিম্মায় নিলেন। পরস্পর পরামর্শের মাধ্যমে কাজ বণ্টন করার মাঝে অনেক উপকারিতা রয়েছে। এর দ্বারা কাজ সহজ এবং দ্রুত হয়। সাথিরা সন্তুষ্ট মনে কাজ করে। প্রত্যেকেই একে অপরের সাহায্যকারী হয়। অবিশ্বাস এবং মতবিরোধ থেকে সকলেই হিফাজতে থাকে। কাজের মাঝে বরকত হয়। কুর’আন ও হাদীসে এ বিষয়ের গুরুত্ব এবং তার উত্তম দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে বিদ্যমান।
সংঘাতপূর্ণ মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে মহান আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত পথ ও মত অনুসরণ করতে হবে। এক আল্লাহর বিশ্বাস, তিনি জগতের সৃষ্টিকর্তা ও ইবাদতের মালিক এ কথা মেনে চলতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে-‘আল্লাহ কি বিচারকদের সর্বোচ্চ বিচারক নয়?’ বিচার দিনের মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীতে মানুষের মাঝে বিচার ফয়সালার দায়িত্ব দিয়ে কিতাব সহকারে হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে-‘আমি আপনাকে কিতাব সহকারে প্রেরণ করেছি এ জন্য যে, আপনি মানুষের মাঝে সত্যিকার বিচার করবেন, আল্লাহ যেভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন ঠিক সেভাবে। আর আপনি খিয়ানতকারীদের পক্ষে বাদানুবাদ করতে যাবেন না। সূরা নিসা, আয়াত: ১০৫
পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনে সঠিক পন্থা অবলম্বন করে যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হয়,তা হাতে কলমে শিখিয়েছেন । তিনি নিজের কারণে কখনো কাউকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাননি। নিজের কারণে কারো থেকে কখনো প্রতিশোধ নেননি। কেবল জনগণের জন্যই অপরাধীর উপর দন্ড কার্যকর করেছেন। জয়নাব বিনতে হারিস নামক খাইবারের ইহুদী মহিলা নবীজিকে হত্যা করার মানসে ছাগল ভুনা করে বিষ মিশ্রিত করে তাঁর নিকট হাদিয়া প্রেরণ করেছিল। সাথে সাথে এ বিষের ক্রিয়া নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সহচররা টের পেলেন। সাহাবীরা তরবারি উঁচিয়ে মহিলার দিকে ধেয়ে আসলে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ মহিলাকে রক্ষা করেন। তাকে কোন শাস্তি দিলেন না। পরবর্তীতে যখন বিশিষ্ট সাহাবী বিশর ইবনে বারা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বিষক্রিয়ায় ইন্তেকাল করলেন, তখন এ হত্যাকান্ডের শাস্তি সরূপ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে মহিলাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন। সূরা আলে ইমরান,আয়াত: ১০৩
আমরা যদি প্রিয় নবীর হাতে গড়া ইসলামী প্রজাতন্ত্র মদীনাতুর রাসূলের দিকে অবলোকন করি তবে বলা যায় শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত- জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। সমাজে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। যথা-
১. ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া: ভ্রাতৃত্ব হচ্ছে ফুল ও পল্লবে শোভিত এক বরকতপূর্ণ বৃক্ষ, নানাভাবে নিরবধি যা ফলদায়ক। ভ্রাতৃত্বের মৌল ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা। ইরশাদ হচ্ছেঃ “তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো : তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতি সঞ্চার করেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে।” এ প্রসঙ্গে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-সে সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! তোমাদের কেউ ততক্ষণ মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে যে কল্যাণ নিজের জন্য পছন্দ করে, তার অপর ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ করে। সহিহ বুখারী; সহিহ মুসলিম
২. প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান ও দয়া প্রদর্শন করা: বিতর্ক করতে হবে সত্য প্রকাশ ও মানুষের প্রতি দয়া-মমতার জন্য। প্রতিপক্ষকে হীন করার উদ্দেশ্যে কিংবা মুর্খ বলার জন্য নয়। মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘‘আর রাহমানের বান্দা তারাই যারা জমিনে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদের সম্বোধন করে তখন বলে ‘সালাম।’’ তাই নবীজিকে হত্যার জন্য হাজার বার যারা চেষ্টা করেছিল বরাবরই তাদের সবাইকে তিনি ক্ষমা করে দিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে আচরণের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
৩. কারো ওপর জুলুম-অবিচার না করা: যার যা প্রাপ্য তাকে তা না দেয়া হলো জুলুম। এটা ব্যক্তির সম্পদ আত্মসাৎ, শারীরিক আক্রমণ বা সম্মানহানির মাধ্যমেও হতে পারে, যা ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক অন্যায় বলে বিবেচিত। আল্লাহর হক আদায় না করলে আল্লাহ ক্ষমা করলেও বান্দার হক বিনষ্টকারীকে আল্লাহ কখনও ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ না যার ওপর জুলুম করা হয়েছে, সে ক্ষমা করে দেয়। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, “হে আমার বান্দা! আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও একে হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’’ সূরা ফুরকান,আয়াত:৬৩
৪.সৎ কাজের আদেশ করা ও অসৎ কাজের নিষেধ করা : এটা সমাজ সংস্কার ও সংশোধনের অনন্য মাধ্যম। এর মাধ্যমে সত্যের জয় হয় এবং মিথ্যা ও বাতিল পরাভূত হয়। যে ব্যাক্তি আন্তরিকতা ও সততার সাথে এ দায়িত্ব পালন করে তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার ও মর্যাদাপূর্ণ পারিতোষিক। ইরশাদ হচ্ছে, “আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত, যারা সৎকাজের প্রতি আহ্বান করবে, নির্দেশ করবে ভালো কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে। আর তারাই হলো সফলকাম।” সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৪
৫. ইনসাফ করা : ইসলামের পরিভাষায় ইনসাফ হচ্ছে কোনো বস্তু তার হকদারদের মধ্যে এমনভাবে বণ্টন করে দেয়া যাতে কারও ভাগে বিন্দুমাত্র কম বেশি না হয়। বসুন্ধরার বুকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার কায়েম নিয়ে আসে নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও শান্তির ফল্গুধারা। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জিন্দেগীর সকল পর্যায়ে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে ইসলাম সমধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। এমনকি মুসলমানদের সাথে কাফিরদের লেনদেন ও সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ইনসাফের নীতিতে অবিচল থাকতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দন্ডায়মান হও। কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রু তা যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জন করতে কোনোভাবেই প্ররোচিত না করে। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।” সূরা মায়েদা, আয়াত: ৮
৬. দ্বীনী শিক্ষা অর্জন ও প্রচার-প্রসার : দুনিয়ার নিযাম ও ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখার জন্য যেমন জাগতিক শিক্ষার প্রয়োজন তেমনি দ্বীনের হিফাজতের জন্য এবং দুনিয়ার সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক করার জন্য দ্বীনী শিক্ষার প্রয়োজন। কুরআন-সুন্নাহর চর্চা ও অনুসরণের অভাব হলে সমাজের সকল অঙ্গনে দুর্নীতি ও অনাচার দেখা দেয়। দেখা দেয় অশান্তি। শিক্ষিত মানুষ পথভ্রষ্ট হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমাজ যতই উন্নতি লাভ করুক ঈমান ও খোদাভীতি না থাকলে তা মানুষের ক্ষতি ও অকল্যাণে ব্যবহৃত হয়। মানুষের সকল আবিষ্কারকে অর্থপূর্ণ ও কল্যাণমুখী করার জন্যই অপরিহার্য প্রয়োজন ইলমে ওহীর চর্চা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘‘আল্লাহ তা’আলা যাকে প্রভূত কল্যাণ দিতে চান তাকে দ্বীনের প্রজ্ঞা দান করেন।’’ সহীহ বুখারী, ১/৬
৭. আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করা : শত্রু-মিত্রের বিচার না করে সব মানুষ যদি সঠিক পথের অনুসারী হতো তবে হক্ব-বাতিল, ঈমান-কুফর, আল্লাহর বন্ধু এবং শয়তানের বন্ধুর মাঝে কোনো পার্থক্য থাকতো না। তাই বন্ধু নির্বাচন ও শত্রু তা পোষণ আল্লাহর জন্য হওয়া উচিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “ঈমানের অধিকতর নিরাপদ বন্ধন হলো আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর জন্য শত্রু তা। সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস : ৪৫৯৯
৮. জবাবদিহিতার মানসিকতা থাকা :মানুষকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত সুষ্ঠু ও স্বচ্ছতার সঙ্গে যথাযথভাবে পালন করতে হবে। বিভিন্ন কাজকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশের উপযুক্ত তত্ত্ব-তথ্য, আয়-ব্যয়, হিসাব-নিকাশ ও লেনদেনকে সুস্পষ্টভাবে জানার জন্য উন্মুুক্ত করাই হলো স্বচ্ছতা। ইহকালীন ও পারলৌকিক উভয় জগতে জবাবদিহিতা রয়েছে। ইরশাদ হচ্ছেঃ ‘অন্তত যে ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে (জবাবদিহি) ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।’’ সূরা নাজিয়াত, আয়াত: ৪০
এই জন্য আমাদেরও পরামর্শের গুরুত্ব বুঝে এর উপর আমল করা উচিত। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সাহায্য করুন এবং সমস্ত অকল্যাণ থেকে হিফজত করুন। আমিন!
Logged
জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের (নারী ও পুরুষ) উপর ফরজ । জ্ঞানের শহর হলেন হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) আর সেই শহরের দরজা হলেন হজরত আলী (রাঃ) । জ্ঞান ব্যতীত কর্ম অর্থহীন আবার কর্ম ব্যতীত জ্ঞান অর্থহীন। জ্ঞানী হও তবে অহংকারী হইও না, ইবাদত কর তবে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে করোনা ।