« on: June 20, 2025, 09:52:32 PM »
সমাজে অপেক্ষাকৃত দুর্বল, হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী: এক অদৃশ্য সংগ্রাম
আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা জীবনের কোলাহলে, আমরা প্রায়শই সমাজের এক বৃহৎ অংশের কথা ভুলে যাই – যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী। এরা সেই মানুষগুলো যারা দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত, যাদের জীবন কাটে মৌলিক চাহিদা পূরণের নিরন্তর সংগ্রামে। ক্ষুধা, অপুষ্টি, রোগ, অশিক্ষা আর অনিশ্চয়তা যাদের নিত্যসঙ্গী। এরা আমাদেরই সমাজের অংশ, অথচ তাদের জীবন যেন এক অদৃশ্য সংগ্রামে আবদ্ধ।
এই জনগোষ্ঠী কারা? তারা হতে পারে প্রান্তিক কৃষক যারা এক চিলতে জমিতে জীবন ধারণের চেষ্টা করে, বা দিনমজুর যারা শহরে বা গ্রামে শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা হতে পারে বিধবা নারী, স্বামী পরিত্যক্তা বা কর্মহীন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। বস্তিবাসী, ভাসমান মানুষ, নদীভাঙনের শিকার বাস্তুহারা পরিবার – এই প্রতিটি মুখই আমাদের সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও হতদরিদ্র অংশের প্রতিচ্ছবি।
তাদের জীবন সংগ্রাম:
খাদ্য সংকট: দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করাই এদের প্রধান দুশ্চিন্তা। পুষ্টিকর খাবারের অভাবে শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে, প্রাপ্তবয়স্কদের কর্মক্ষমতা কমে যায়।
স্বাস্থ্যহীনতা: সুচিকিৎসা তাদের জন্য এক বিলাসিতা। সামান্য সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে গুরুতর ব্যাধিও তাদের জন্য মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ চিকিৎসার খরচ মেটানোর সামর্থ্য তাদের নেই।
শিক্ষাবঞ্চিত: অভাবের তাড়নায় শিশুরা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়, অথবা কখনোই স্কুলের মুখ দেখে না। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হওয়ায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রেই আটকা পড়ে।
গৃহহীনতা ও আশ্রয়হীনতা: যাদের নিজস্ব জমি নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তারা বস্তির ঝুপড়ি বা রাস্তার ধারে দিন কাটায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে।
কর্মসংস্থানহীনতা ও অনিশ্চয়তা: দক্ষতার অভাব, শারীরিক দুর্বলতা এবং সুযোগের অভাবে তারা প্রায়শই বেকার থাকে। যখন কাজ মেলে, তখনো তা খুবই স্বল্প আয়ের এবং অনিশ্চিত।
সামাজিক বঞ্চনা ও অবহেলা: দারিদ্র্যের কারণে সমাজে তারা প্রায়শই অবহেলিত ও নিগৃহীত হয়। তাদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না, তাদের অধিকার প্রায়শই লঙ্ঘিত হয়।
কেন এই দুর্বলতা?
এই দুর্বলতা কেবল ব্যক্তিগত অযোগ্যতা নয়, এর পেছনে কাজ করে বহু কাঠামোগত কারণ:
সম্পদের অসম বন্টন: ভূমি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের অসম বন্টন।
দুর্বল সামাজিক নিরাপত্তা জাল: দরিদ্রদের জন্য পর্যাপ্ত ও কার্যকর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অভাব।
নীতিমালার দুর্বলতা: দরিদ্রবান্ধব নীতিমালার অভাব অথবা বিদ্যমান নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বন্যা, খরা, নদীভাঙন—প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো দরিদ্রদের আরও প্রান্তিক করে তোলে।
শিক্ষা ও দক্ষতার অভাব: শিক্ষার অভাবে ভালো কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া।
আমাদের করণীয়:
এই হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সকলের ভূমিকা রয়েছে:
দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি: কার্যকর দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি গ্রহণ এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন।
শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ: দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা এবং বেকারদের জন্য কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রদান।
স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা: গ্রামীণ ও বস্তি এলাকায় উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া এবং বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধের ব্যবস্থা করা।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী: বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা—এই ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো এবং তা প্রকৃত হতদরিদ্রদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ: ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করার জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও পরামর্শ প্রদান।
সচেতনতা বৃদ্ধি: সমাজে তাদের প্রতি সহমর্মিতা ও সংবেদনশীলতা বাড়ানো এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা।
সমাজের এই দুর্বলতম অংশকে বাদ দিয়ে একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, তাদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করাই একটি মানবিক ও প্রগতিশীল সমাজের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত। আসুন, আমরা সকলে মিলে এই অদৃশ্য সংগ্রামরত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াই, তাদের জীবনে আশার আলো জ্বালাই এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি।

Logged
জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের (নারী ও পুরুষ) উপর ফরজ । জ্ঞানের শহর হলেন হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) আর সেই শহরের দরজা হলেন হজরত আলী (রাঃ) । জ্ঞান ব্যতীত কর্ম অর্থহীন আবার কর্ম ব্যতীত জ্ঞান অর্থহীন। জ্ঞানী হও তবে অহংকারী হইও না, ইবাদত কর তবে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে করোনা ।