« on: August 06, 2019, 11:35:40 PM »
অটিজম ও আমাদের অসাধারণ শিশুরা
‘নয়ন’ নামের একটি ছেলে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠে নির্দিষ্ট বয়সে স্কুলে যেতে শুরু করে। কিন্তু হঠাৎ করে সে কথা বলা কমিয়ে দেয়। একা থাকতে পছন্দ করে। ক্লাসের শিক্ষক বা বন্ধুরা কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় না। ক্লাসে শিক্ষক ছবি আঁকতে বা কোনো কিছু লিখতে দিলে পেনসিল ধরে না। তখন শিক্ষক নয়নের মা-বাবাকে বিষয়টা জানালে মা-বাবা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে তাকে নিয়ে যান। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন, নয়ন অটিজমে আক্রান্ত।
২ এপ্রিল, ২০১৯ বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশে এই দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে। ২০১১ সালের ২৫ জুলাই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বিশ্বের অটিজম আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে একটি ফলপ্রসূ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দেশে অটিজম আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি বৈশ্বিক অটিজম কর্মসূচিতে নেতৃত্বদানকারী মার্কিন সংস্থা ‘অটিজম স্পিকসে’র সদস্য। মূলত তাঁর প্রচেষ্টায় দেশে অটিজম সচেতনতা ও জাগরণ তৈরি হয়। অটিজম হলো মস্তিষ্কের একটি স্নায়বিক সমস্যা, যা মস্তিষ্কের সাধারণ কর্মক্ষমতাকে ব্যাহত করে। যার লক্ষণ শিশু জন্মের তিন বছরের মধ্যেই প্রকাশ পায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৮ মাস এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে জন্মের পর থেকেই শিশুর আচরণ অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। যেমন—বড়রা নানাভাবে নানা কথা বলে শিশুর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু এ ধরনের শিশুরা তাতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। অথবা কোনো একটি বস্তু হাতে নিয়ে সেটার প্রতি মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। এ ছাড়া জন্মের পর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে এমন শিশুর মধ্যেও অটিজমের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট লিও ক্যানার (খব িকধহহবৎ) ১৯৪৩ সালে প্রথম অটিজম আবিষ্কার করেন। এক তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি ৫০০ জনে একজন অটিস্টিক শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যাবলি : প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩-এর বর্ণনা অনুযায়ী অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের ১০টি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা হয়েছে। যথা—এক. মৌখিক বা অমৌখিক যোগাযোগে সীমাবদ্ধতা, দুই. সামাজিক ও পারস্পরিক আচার-আচরণ, ভাববিনিময় ও কল্পনাযুক্ত কাজকর্মের সীমাবদ্ধতা, তিন. একই ধরনের বা সীমাবদ্ধ কিছু কাজ বা আচরণের পুনরাবৃত্তি, চার. শ্রবণ, দর্শন, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ, ব্যথা, ভারসাম্য ও চলনে অন্যদের তুলনায় বেশি বা কম সংবেদনশীলতা, পাঁচ. বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা বা অন্য কোনো প্রতিবন্ধিতা বা খিঁচুনি, ছয়. এক বা একাধিক নির্দিষ্ট বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতা এবং একই ব্যক্তির মধ্যে বিকাশের অসমতা, সাত. চোখে চোখ না রাখা বা কম রাখা; আট. অতিরিক্ত চঞ্চলতা বা উত্তেজনা, নয়. অসংগতিপূর্ণ হাসি-কান্না, দশ. অস্বাভাবিক শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ও একই রুটিনে চলার প্রচণ্ড প্রবণতা। বর্ণিত প্রথম তিনটি লক্ষণের উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে এবং পরবর্তী লক্ষণগুলোর মধ্যে যদি এক বা একাধিক লক্ষণ কোনো শিশুর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়, তখন তাকে অটিস্টিক শিশু বা ব্যক্তি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
অটিস্টিক শিশুর মূল তিন সমস্যা : অটিজমে আক্রান্ত শিশু বা অটিস্টিক শিশু সাধারণত যোগাযোগ ও সামাজিক আচরণে বয়সের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকে। যে তিনটি প্রধান সমস্যা অটিস্টিক শিশুর ভেতর থাকে, তা হলো যথা—এক. মৌখিক ও অমৌখিক যোগাযোগে সমস্যা, সামাজিক আচরণে সমস্যা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ সমস্যা। মৌখিক ও অমৌখিক যোগাযোগে সমস্যাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লক্ষণগুলো হলো—অটিস্টিক শিশুর ভাব প্রকাশের মতো কথা বলা দেরিতে শুরু হয় বা একেবারেই অনুপস্থিত থাকে ও ভাব প্রকাশের বিকল্প উপায় এদের বিকাশ পায় না। অনেকেই কথা গুছিয়ে বলতে পারে না। একই শব্দ বা বাক্য বারবার বলার প্রবণতা থাকতে পারে। এরা কারো চোখের দিকে তাকায় না। সে ক্ষেত্রে অন্যের মুখভঙ্গি বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশিত ভাব তারা বুঝতে পারে না। অনেকেই অর্থহীন কথা বলে। নিজেকে প্রকাশের জন্য যথাযথ ভাষার ব্যবহার এরা জানে না বা অন্যের ভাষা বোঝার ক্ষমতাও এদের থাকে না।
অটিজমের কারণ : অটিজমের কারণ কী—এখনো পর্যন্ত এর কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে মস্তিষ্কের কোনোরূপ গঠনগত ক্ষতি। অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক ক্রিয়া। শরীরে নিউরোকেমিক্যাল ক্রিয়ার অসামঞ্জস্যতা। শিশুর জন্মপূর্ব বা জন্মের পরবর্তীকালে কোনো সংক্রমণ, ক্রমোজমগত অস্বাভাবিকতা হতে পারে। শিশুকালীন টিকা, বিশেষ করে এমএমআর টিকা। জন্মের সময় শিশুর অক্সিজেনের অভাব। শিশুর কোনো কারণে খিঁচুনি হলে। প্রসবের সময়ে সিন্টসিনন ড্রিপ ব্যবহার। অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ এবং বংশগত কারণ অন্যতম। নানা কারণ বলা হলেও এখনো পর্যন্ত অটিজমের কোনো নির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করা হয়নি। তবে কোনো কোনো চিকিৎসাবিজ্ঞানী বয়স্ক মা-বাবাকে অটিজম হওয়ার জন্য দায়ী মনে করেন।
অটিজম শনাক্তকরণ : নিম্নের বিষয়গুলো একটি শিশুর ভেতর দেখা গেলে খুব দ্রুত অটিজম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া দরকার। যেমন—শিশুর নিজের নাম শুনে না তাকালে, শিশু বাবলিং শব্দগুলো না করলে। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে কোনো কিছু পয়েন্ট করে না দেখালে। কথা বলার সময় কারো সঙ্গে আই কন্টাক্ট না করলে। কেউ কিছু দিলে সেটা না ধরলে বা ধরলেও সেটা হাত থেকে পড়ে গেলে। নিজের পছন্দের বস্তুটি নিয়ে অন্যের সঙ্গে অংশগ্রহণ না করলে। ১৬ মাসের ভেতর একটি শব্দ কিংবা দুই বছরের ভেতর দুটি শব্দের বাক্য না বললে। অর্জিত যোগাযোগ ও সামাজিক দক্ষতা যদি আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। যত দ্রুত অটিজম শনাক্ত করা যায় এবং যত তাড়াতাড়ি অটিজম আক্রান্ত শিশুকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে সম্পৃক্ত করা যায় তত দ্রুত তার উন্নতি সম্ভব হয়।
অটিজম প্রতিরোধ ও চিকিৎসা : অটিজম প্রতিরোধে জন্মের আগে প্রত্যেক গর্ভবতী মায়ের অটিজম বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন গর্ভাবস্থায় পরিমাণমতো পুষ্টিকর খাবার। কারণ অপুষ্টি আর প্রতিবন্ধিতার মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক তা আজ গবেষণায় প্রমাণিত। অটিস্টিক আক্রান্ত হয়ে কোনো শিশু জন্ম নিলে তার প্রথম চিকিৎসা হচ্ছে শনাক্তকরণ। পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন নিবিড় পরিচর্যা এবং বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা। অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশকে নিবিড় পরিচর্যা, সঠিক চিকিৎসা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের বৃদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাদের বেশির ভাগ স্কুলে স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে পড়ালেখা করতে পারে। কিছুসংখ্যক শিশুর জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষায়িত স্কুল। বাদবাকি প্রায় ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ শিশু সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও স্বাধীনভাবে বা এককভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারে না—তাদের অন্যের ওপর নির্ভর করে চলতে হয়। তাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আজীবন ‘অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজ-অর্ডারস’ নামের প্রতিবন্ধিতা।
শেষ কথা : অটিস্টিক সম্ভাবনাময় শিশু—বেশির ভাগ অটিস্টিক শিশু অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হয়। প্রতি ১০ জন অটিস্টিক শিশুর মধ্যে একজনের ছবি আঁকায়, গানে, গণিতে বা কম্পিউটারে প্রচণ্ড দক্ষতা থাকে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে অটিস্টিকরাও কর্মে সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখতে পারবে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘কর্মসংস্থানে অটিজম সুবিধা’। অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, আইজাক নিউটন অটিস্টিক ছিলেন। যাঁরা স্বকর্মগুণেই বিশ্বখ্যাত। এ জন্য প্রয়োজন অটিস্টিক শিশুর প্রতি সবার সহযোগিতা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
লেখক : প্রতিবন্ধিতা বিশেষজ্ঞ ও চেয়ারপারসন, মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
« Last Edit: August 06, 2019, 11:37:49 PM by Farhana Haque »
Logged
কারো মত নয় আমরা হবো যার যার মত। প্রতিজন "আমি" হবো এক একটি আদর্শ। জীবন একটিই। সময় অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। নিজেকে প্রমান করার এবং ভালো কাজ করার এখনই সময়।