Dear All,
Mr. Mohammad Omar Faruk (Fahim) is an student of Department of Law of Dhaka University.
Following article is written by him and published in Daily Prothom Alo of October 7, 2012.
Please read it...........
ভবঘুরে জীবনের হোক অবসান
মুহাম্মদ ওমর ফারুক
ফার্মগেট ওভারব্রিজ এলাকায় থাকে শিউলীদের পরিবার। ভোলা থেকে এসেছে এক বছর আগে। রাত কাটে এখানেই। কখনো পুলিশ সরিয়ে দিলে মিরপুর-১০-এ চলে যায়। আবার চলে আসে। এখানে নাকি রোজগার ভালো। নিউমার্কেট ও গুলিস্তান এলাকায় গিয়ে তোরাব আলী ও সালেহার পরিবারের একই দশা দেখা গেল। তোরাব আলীর বসতভিটাও নদীতে তলিয়ে গেছে আর সালেহা ভাড়ার টাকা দিতে পারেননি বলে মালিক ঘরে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। তাই রাস্তার পাশের ফুটপাতেই আশ্রয় নিতে হয়েছে পরিবারসমেত। তাঁদের প্রশ্ন করা হলো, সরকার যদি তাঁদের পুনর্বাসনকেন্দ্রে নিয়ে যায়, তবে তাঁরা যাবেন কি না। উত্তরে তাঁরা বললেন, তাঁদের পরিবারের সবাইকে নেওয়া হবে কি না, তাঁরা একসঙ্গে থাকতে পারবেন কি না! একটু বাড়িয়ে তাঁরা বললেন, তাঁদের যদি আশ্রয়কেন্দ্রে না নিয়ে কিছু টাকা দেওয়া হয়, তাহলে তাঁরা ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করবেন, গায়ে খেটে একটা আশ্রয় জোগাড় করে নেবেন।
ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র রাস্তাঘাটে, ফুটপাতে, পার্কে, ওভারব্রিজে পরিচিত দৃশ্য হিসেবে বিচরণ করতে দেখা যায় অর্ধনগ্ন ভবঘুরে ভাসমান মানুষ আর ভিক্ষুকদের। আশ্রয়হীন এসব মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকেন। উন্মুক্ত জায়গায় তাঁদের অবস্থানের ফলে পরিবেশেরও মারাত্মক দূষণ হচ্ছে। নিম্নমানের জীবনযাপনে মাদকের বিষাক্ত ছোবলে তাঁরা পর্যুদস্ত, কিন্তু তাঁদের কোথাও আশ্রয় নেই বলেই কেবল তাঁরা এসব স্থানে অবস্থান নেন, সেটিও একটি বিবেচনার ব্যাপার।
সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য সচেষ্ট থাকার কথা। অবশ্য বর্তমান সরকার ভবঘুরেদের পুনর্বাসনের জন্য ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন ২০১১ প্রণয়ন করে পুরোনো ভবঘুরে-সংক্রান্ত আইনকে রহিত করে পুনঃপ্রণয়ন ও সংহত করেছে। কিন্তু এই আইনে উল্লিখিত অনেক উদ্যোগই বাস্তবায়নযোগ্য কি না এবং হলেও তা কত দূর, তা নিয়ে একটি বিতর্ক রয়েছে। ২০১১ সালের ২৪ আগস্ট এই নতুন আইনটি পাস হওয়ার আগেই খসড়া বিলটি নিয়েই বিভিন্ন এনজিও, মানবাধিকারকর্মীরা বিরোধিতা করে আসছিলেন। তাই সমালোচিত কিছু ধারা-উপধারা বাতিল করে বিলটি পাস হয়।
ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন ২০১১-তে ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তির সংজ্ঞা দিয়ে কীভাবে ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তিকে পুনর্বাসিত করা যাবে, সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সৃষ্টি করা হয়েছে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ। রাস্তা থেকে আটকের পর আদালত কর্তৃক ভবঘুরে ঘোষিত হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া এবং সেখানে অবস্থানসহ নানা দিক ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই আইনে।
ভবঘুরে বলতে বোঝানো হয়েছে, ‘এমন কোনো ব্যক্তি যাহার বসবাসের বা রাত্রি যাপন করিবার মতো সুনির্দিষ্ট কোনো স্থান বা জায়গা নাই অথবা যিনি কোনো উদ্দেশ্য ব্যতীত অযথা রাস্তায় ঘোরাফিরা করিয়া জনসাধারণকে বিরক্ত করেন অথবা যিনি নিজে বা কাহারো প্ররোচনায় ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত হন; তবে কোনো ব্যক্তি দাতব্য, ধর্মীয় বা জনহিতকর কোনো কাজের উদ্দেশ্যে অর্থ, খাদ্য বা অন্য কোনো প্রকার দান সংগ্রহ করলে এবং উক্ত উদ্দেশ্যে বা কাজে তা ব্যবহার করলে তিনি এর অন্তর্ভুক্ত হবেন না। আর নিরাশ্রয় ব্যক্তি অর্থ এমন কোনো ব্যক্তি যাহার বসবাসের বা রাত্রি যাপন করিবার মতো সুনির্দিষ্ট স্থান বা জায়গা এবং ভরণপোষণের জন্য নিজস্ব কোনো সংস্থান নাই এবং যিনি অসহায়ভাবে শহর বা গ্রামে ভাসমান অবস্থায় জীবনযাপন করেন এবং সরকার কর্তৃক, সময় সময়, প্রদত্ত বিভিন্ন ভাতা, সাহায্য, ইত্যাদি লাভ করেন না।’
ভবঘুরের সংজ্ঞার সমালোচনা আগে থেকে হলেও এর সঙ্গে নতুন আইনে কেবল ‘যিনি কোনো উদ্দেশ্য ব্যতীত অযথা রাস্তায় ঘোরাফিরা করিয়া জনসাধারণকে বিরক্ত করেন’ শব্দগুলো যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার নতুন হাতিয়ার তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। আবার জনসাধারণকে ঠিক কী কাজ করে বিরক্ত করা হলে তা আমলে আসবে, সে ব্যাপারেও স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। তাই ব্যাপারটি পুলিশের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করবে। আইনে বলা হয়েছে, সরকার-নির্ধারিত এলাকায় প্রয়োজনীয় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করবে। এই আইনে দু-এক দিনের জন্য কাউকে হয়রানিমূলক আটক করার সুযোগ রয়ে গেছে। কারণ, এই আইনেই বলা হয়েছে, ভুলবশত আটকের জন্য পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যাবে না।
আইনের তৃতীয় ধারায় এসব ভবঘুরে, নিরাশ্রয় ব্যক্তিকে আশ্রয়দানের জন্য সরকারি অভ্যর্থনাকেন্দ্র এবং সরকারি বা বেসরকারি আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে এবং ঢাকা ও ঢাকার বাইরের জেলায় এক বা একাধিক সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন ও সরকার কর্তৃক বেসরকারি আশ্রয়কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা করার নীতিও গৃহীত হয়েছে। বর্তমানে দেশে এ ধরনের ছয়টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে, যার প্রধানটি রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত।
আইনে কোনো শিশুসন্তানসহ আটককৃত নারীকে সন্তানের সঙ্গে থাকার অনুমতি দেওয়া ছাড়াও গর্ভবতী নারীদের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তবে ব্যক্তি নিজে বা তাঁর পক্ষে জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট বরাবরে আবেদন করতে বলা হয়েছে। ভবঘুরেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কেও দেওয়া হয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। অভ্যর্থনাকেন্দ্রে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও তার প্রতিবেদন তৈরি করে ভবঘুরে ব্যক্তি কুষ্ঠ, এইডস বা কোনো ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত কি না, পরীক্ষা করে প্রয়োজনমতো সরকারি হাসপাতাল বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর কথা বলা আছে। কিন্তু সাত বছরের বেশি শিশুদের মায়ের সঙ্গে থাকার বিধান না থাকায় শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
আইনে ভবঘুরেকে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে কীভাবে মুক্তি দেওয়া হবে, সে নির্দেশনা রয়েছে। সে মতে, নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে বা সন্তোষজনক চাকরির ব্যবস্থার পর অথবা কোনো ব্যক্তি তাঁর দায়িত্ব নিলে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে তিনি মুক্তি পাবেন। যদি কোনো ভবঘুরে ওই মেয়াদের মধ্যে অনুমতি ব্যতীত পালিয়ে যান, তবে তিনি তিন মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর যেসব ভবঘুরেকে কেউ ভিক্ষাবৃত্তিতে প্ররোচনা দিয়ে থাকে, তবে প্ররোচনাকারী দণ্ডবিধি ১৮৬০, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬সহ এ-সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী শাস্তি ভোগ করবেন।
দেশে কেবল ভিক্ষুকের সংখ্যা নয় লাখের মতো, অথচ আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ছয়টি; যেগুলোতে মোট এক হাজার ৯০০-এর মতো আসন রয়েছে। এ ছাড়া সমাজসেবা অধিদপ্তরের তিনটি দুস্থ শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনকেন্দ্রে প্রায় ৭৫০টি আসন রয়েছে। এই বিশাল ভিক্ষুক জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসিত করতে প্রতিটি জেলায় নির্দিষ্টসংখ্যক কেন্দ্র স্থাপন জরুরি।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ৮০ ভাগ ভিক্ষুক পুনর্বাসনের জন্য নিজ জেলায় যেতে চান এবং ৯৩ ভাগ ভিক্ষুক সরকারি সাহায্য পেলে এ পেশা ছাড়তে চান। তাই ভবঘুরে লোকের নিজ নিজ জেলায় স্বল্প মেয়াদে পুনর্বাসিত করাই যৌক্তিক হবে।
প্রণীত এই আইনে গঠিত হওয়া ভবঘুরে বোর্ডের গঠন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অগ্রগতি খুবই সামান্য। অথচ সরকারের সদিচ্ছা, কর্মকর্তাদের নৈতিক ইচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে এই আইনের মাধ্যমে যাঁরা একদমই সহায়-সম্বলহীন কিংবা ইচ্ছা করে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত থাকেন—এমন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর ভবঘুরেদের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে, অন্যান্য শ্রেণীর ভিক্ষুক, যাঁদের থাকার মতো জায়গা আছে, তবে মৌসুমিভাবে ভবঘুরে হন, তাঁদের সরকারি সাহায্য প্রদান করে ক্ষুদ্র ব্যবসার ব্যবস্থা করলে ভবঘুরে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভিক্ষুকবিষয়ক সেলের হিসাব অনুযায়ী ৬১ ভাগ ভিক্ষুক সেটাই চান। ভিক্ষুক ভবঘুরেদের শ্রেণী নির্ধারণ করে কয়েক স্তরের ব্যবস্থা নিয়ে এভাবে শিউলী, সালেহা আর তোরাব আলীদের ঠাঁই নেওয়ার মতো একটু জায়গা দিতে পারলে খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টির সঙ্গে তাঁদের কান্নাও হয়তো আর মিলিয়ে যাবে না হতাশার গভীর কুয়াশায়।
মতামত
ভবঘুরে আইনের উদ্দেশ্য মহৎ। তবে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন কতটা হবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। ভবঘুরেদের চলাচলের স্বাধীনতার মতো কিছু ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা আছে। উপযুক্ত তহবিল গঠন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন আগেই নিশ্চিত না করলে এসব আইন বাস্তবায়নযোগ্য বলে গণ্য হওয়ার নয়।
ড. মিজানুর রহমান
চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনSource:
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-10-07/news/295697