Author Topic: এতিমদের সরদার  (Read 5869 times)

0 Members and 1 Guest are viewing this topic.

ashraful.diss

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 385
  • জ্ঞানী হও তবে অহংকারী হইও না
    • View Profile
    • Email
এতিমদের সরদার
« on: February 01, 2023, 04:37:04 AM »


এতিমদের  সরদার

আবদুল মুত্তালিবের পুত্র আব্দুল্লাহ, আবদুল ওয়াহাবের মেয়ে আমিনাকে বিয়ে করলেন। এই বিয়ের কয়েক মাস পর তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে  সফর করলেন। অত:পর তিনি রাস্তায় অসুস্থ হয়ে ইন্তেকাল করলেন।

এই সময় তার স্ত্রী আমিনা গর্ভবতী ছিলেন। তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হলেন। কারণ তার গর্ভের এই সন্তানটি কিছু দিন পরে এতিম অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করবে।

আমিনা যখন সন্তানটি প্রসব করলেন তখন তার দাদা আব্দুল মুত্তালিব অত্যন্ত খুশী হলেন এবং তার নাম রাখলেন মুহাম্মদ। মক্কার প্রথা অনুযায়ী ধাত্রীরা ধনীদের সন্তানদেরকে দুধ পান করানোর উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসলো। যখনই কোনো মহিলা জানতে পারে যে, মুহাম্মদ একজন এতিম, তখন তাকে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারপর অন্য এমন সন্তান খোঁজে যার বাবা রয়েছে এবং ধনী, যাতে তাকে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ প্রদান করতে পারে। পরিশেষে হালিমা সাদিয়া আসলেন এবং এই এতিমকে গ্রহণ করলেন। পরিশেষে তিনি তার পরিবার-পরিজনের জন্য বরকতের কারণ হয়ে গেলেন।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ পাঁচ বছর তার কাছে অবস্থান করলেন। তারপর তিনি তার মায়ের কাছে ফিরে আসলেন। মায়ের কোলে মাত্র অল্প দিন তিনি তার আদর-স্নেহ ও মমতার মাঝে বসবাস করতে পারলেন। তার বয়স যখন ছয় বছর, তখন তাঁর মা চির বিদায় নিলেন। এভাবেই  তিনি শৈশব থেকেই মায়ের স্নেহ  ও বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হলেন, কিন্তু আল্লাহর দয়া ও করুণা তাঁকে কখনই ছেড়ে যায়নি। তাঁর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা আল্লাহ সহজ করে দিলেন। দাদা আব্দুল  মুত্তালিব দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন এবং তাঁর সাথে সুন্দর ব্যবহার করলেন। কিন্তু তিনিও এর দুই বছর পর মৃত্যু বরণ করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল আট বছর। অত:পর লালন পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন চাচা আবু তালিব। তাঁর উপার্জন করার ক্ষমতা হওয়া পর্যন্ত তিনিই তার দেখাশুনা ও দায় দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তারপর তিনি মহান করুণাময় আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নবুওয়ত প্রাপ্ত হলেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন, 

أَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيمًا فَآَوَى وَوَجَدَكَ ضَالًّا فَهَدَى وَوَجَدَكَ عَائِلًا فَأَغْنَى

অর্থ : তিনি কি তোমাকে এতিম রূপে পাননি। অত:পর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি তোমাকে  পেয়েছেন পথহারা, অত:পর  পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি তোমাকে পেয়েছেন নি:স্ব, অত:পর অভাবমুক্ত করেছেন। (সুরা দোহা: ৬-৮)
 
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় আল্লাহর বাণী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এতিম প্রতিপালন ও তাদের দায়িত্বভার গ্রহণ করছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ

অর্থ: সুতারাং তুমি এতিমদের প্রতি কঠোর হবে না। (সূরা দোহা: ৯)

এতিমের গুপ্তধন

আল্লাহর আদেশে মূসা আলাইহিস সালাম খিজির আ:-এর সাথে ঘুরাফিরার জন্য সময় নির্ধারণ করলেন। যেখানে মূসা আ: এই সামান্য সময়ে খিজির আ: থেকে অনেক শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। খিজির আ:- কে আল্লাহ এমন ইলম দান করেছিলেন যা অন্য কাউকে দেননি। আল্লাহ তালাআ তার সম্পর্কে বলেন:

آَتَيْنَاهُ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنَا وَعَلَّمْنَاهُ مِنْ لَدُنَّا عِلْمًا

অর্থ: আমি তাকে আমার পক্ষ থেকে রহমত দান করেছিলাম এবং আমার পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান।  (সূরা কাহফ: ৬৫)

তাদের দু’জনের চলার পথে বেশ ক্ষুধা পেলো। দূর থেকে একটা শহর দৃষ্টিগোচর হলে তারা সেই শহরের দিকে অগ্রসর হলেন । সেখানে গিয়ে শহরবাসীর কাছে খানার আবদেন করলেন। কিন্তু ঐ শহরের বাসীন্দারা ছিল কৃপণ । তাই তারা তাদেরকে খাদ্য দিতে অস্বীকার করলো। শেষ পর্যন্ত তারা শহরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলেন।

হঠাৎ করে খিজির আ: একটা পুরাতন প্রাচীর দেখতে পেলেন যা ভেংগে পড়ার উপক্রম ছিল। তিনি প্রাচীরের কাছে গেলেন এবং তা মেরামত করে দিলেন।  এদিকে খিজির আ:-এর কাজ  দেখে মূসা আ: আশ্চর্য্য ও বিস্মিত হয়ে গেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, কি করে এমন সম্প্রদায়ের দেয়াল মেরামত করে দেয়া হলো যে সম্প্রদায় এক লোকমা খাদ্য প্রদান করলো না।

প্রকৃত পক্ষে খিজির আ:-এর এই কাজের পিছনে হিকমত ছিল। তিনি  মূসাকে আ: সেই গোপন তথ্য বর্ণনা  করে বলেন যে, প্রাচীরের নিচে মূল্যবান গোপ্তধন লুকায়িত আছে যার মালিক হচ্ছে শহরের দুই জন ছোট এতিম। যদি তিনি প্রাচীরটি ঐ অবস্থায় রেখে যেতেন তাহলে অনতিবিলম্বে দেয়ালটি ভেংগে পড়ে গুপ্তধনটি প্রকাশ হয়ে যেত এবং জালিম কৃপণ সম্প্রদায় এগুলি নিয়ে নিত। তিনি প্রাচীরটি মেরামত করেছেন যাতে গুপ্তধন এতিমদ্বয় বড় হওয়া পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকে। বড় হওয়ার পর কেউ আর তাদের থেকে তাদের সম্পদ কেড়ে নেয়ার সাহস পাবে না।  আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:

وَأَمَّا الْجِدَارُ فَكَانَ لِغُلَامَيْنِ يَتِيمَيْنِ فِي الْمَدِينَةِ وَكَانَ تَحْتَهُ كَنْزٌ لَهُمَا وَكَانَ أَبُوهُمَا صَالِحًا فَأَرَادَ رَبُّكَ أَنْ يَبْلُغَا أَشُدَّهُمَا وَيَسْتَخْرِجَا كَنْزَهُمَا رَحْمَةً مِنْ رَبِّكَ وَمَا فَعَلْتُهُ عَنْ أَمْرِي ذَلِكَ تَأْوِيلُ مَا لَمْ تَسْطِعْ عَلَيْهِ صَبْرًا

অর্থ: আর প্রাচীরের বিষয়টি হল, তা ছিল শহরের দু’জন এতিম বালকের এবং তার নিচে ছিল তাদের গুপ্তধন। আর তাদের পিতা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। তাই আপনার রব চাইলেন যে, তারা দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে তাদের গুপ্তধন বের করে নেবে। এসবই আপনার রবের রহমত স্বরূপ। আমি নিজ থেকে তা করিনি। এ হলো সে বিষয়ের ব্যাখ্যা, যে সম্পর্কে আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারেননি। (সূরা কাহাফ: ৮২)

এতিমের প্রতি আমিরুল মুমিনীন ওমর রা.-এর দয়া

আমিরুল মুমিনীন ওমর বিন খাত্তাব রা. এক রাতে মুসলিমদের অবস্থা অবলোকন করার জন্য বের হলেন। তিনি রাস্তায় চলা অবস্থায় প্রজ্জ্বলিত আগুন দেখতে পেলেন। আস্তে আস্তে সেই আগুনের নিকটবর্তী হলেন। দেখতে পেলেন, একজন নারী একটি পাতিলের নিচে আগুন জ্বালাচ্ছে, আর তার পাশে ছোট ছোট কিছু ছেলে কান্নাকাটি করছে। আমিরুল মুমিনীন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন ছেলেগুলি কান্নাকাটি করছে? নারী তাঁকে বললেন, তারা ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: আগুনের উপর পাতিলটিতে কি রয়েছে? মহিলাটি বললো: পাতিল পানি ভর্তি করে নিচে আগুণ দিয়েছি যাতে ছেলেরা ধারণা করে যে, খাদ্য রান্না করা হচ্ছে এবং  কান্না থেকে বিরত থেকে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে যায়। এ কথা শুনে ওমর বিন খাত্তাব রা. দু:খ পেলেন এবং কেঁদে ফেললেন।  অত:পর অতিদ্রুত বাইতুল মালে আসলেন এবং সেখান থেকে কিছু আটা, খেজুর, ঘি, কাপড় ও কিছু দিরহাম সাথে নিয়ে খাদেমকে বললেন: এগুলো আমার ঘাড়ে উঠিয়ে দাও। খাদেম তাঁর পরিবর্তে নিজেই বহণ করতে ইচ্ছা করলে তিনি তাকে বললেন: না আমি নিজেই তা বহণ করব, কারণ আমি কিয়ামতের দিন তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হব।

আমিরুল মুমিনীন বস্তাটি নিজেই ঘাড়ে করে বহণ করত: মহিলাটির বাড়ীতে পৌঁছলেন এবং নিজেই খাদ্য প্রস্তুত করলেন তারপর ছেলেগুলিকে পরিতৃপ্তি সহকারে খাইয়ে দিলেন।

এতিমের দুআ

কথিত আছে এক ব্যক্তি মদ্য পান ও গুনাহর কাজ করত। এক প্রচণ্ড শীতের রাতে রাস্তা দিয়ে চলতে ছিল। অত:পর দেখতে পেলো, একটি ছোট ছেলে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদছে ও প্রচণ্ড শীতের কারণে কাঁপছে।  ছেলিটির সাথে সে কথাবর্তা বললো,  পরিচয় নিয়ে জানতে পারল যে, সে একজন এতিম। তার দুরাবস্থা দেখে লোকটি  প্রভাবিত হলো। সে ছেলেটিতে খানা খাইয়ে দিলো এবং নিজের পোষাক খুলে তাকে দিলো যাতে সে শীতের কষ্ট থেকে রক্ষা পায়। তারপর নিজ বাড়ীতে ফিরে আসলো এবং ঘুমিয়ে পড়লো। স্বপ্নে দেখলো যেন কেয়ামত উপস্থিত হয়েছে। মানুষ হিসাব নিকাশের জন্য দাড়িয়েছে, আর তার নিজের ব্যাপারে সে দেখছে যে, আজাবের ফেরেশতাগণ এসে তাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের সামনে সে লাঞ্জিত ও অপমাণিত হচ্ছে। আর যে মুহূর্তে তাকে আগুনের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই মুহূর্তে সেই এতিমের সাথে দেখা হলো। এতিমটি তার দুরাবস্থা দেখে আল্লাহর কাছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলো। আল্লাহ এতিমের প্রার্থনা কবুল করলেন এবং ফেরেশতাদেরকে এতিমের প্রতি ভাল ব্যবহারের কারণে তাকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন, লোকটির হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে সে ভীত হয়ে পড়লো। অত:পর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলো। গুনাহ থেকে তাওবা করলো ও পাপকাজ ছেড়ে দিলো এবং আল্লাহর আনুগত্যশীল বান্দায় পরিণত হয়ে গেল। এবং সংকল্প করলো যে,  সব সময় এতিমের প্রতি ভাল ব্যবহার করবে।

বর্ণিত আছে আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহ. এতিমদেরকে খেজুর দিয়ে বলতেন। তোমরা আমাকে খেজুরের আটি দাও, আমি তোমাদেরকে দিরহাম দিব। অত:পর এতিমরা তার কাছ থেকে খেজুর নিয়ে যেত এবং ঠাণ্ডা পানি পান করত ও আটিগুলি ফেরত দিয়ে  প্রতিটি আটির পরিবর্তে একটি করে দিরহাম গ্রহণ করত। তারপর তারা তাদের উদর পূর্ণ ও পকেট ভর্তি করে খুশি হয়ে রেব হতো। 

এদিকে আব্দুল্লাহ বিন মুবারক বিনয়ের সাথে আওয়াজ করে ক্রন্দন করতেন। এমনকি অশ্রু দিয়ে চেহারা ও দাড়ি ভিজে যেত। তার এক ছাত্র তাকে জিজ্ঞেস করল। আপনি এতিমের উদর পরিতৃপ্ত করেছেন এবং তাদের পকেট দিরহাম দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। এর পরও কোন জিনিস আপনাকে কাঁদাচ্ছে?

তিনি উত্তরে বললেন: হে ভাই! আমাদের সম্মুখে শক্ত ঘাটি রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

فَلَا اقْتَحَمَ الْعَقَبَةَ وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْعَقَبَةُ فَكُّ رَقَبَةٍ أَوْ إِطْعَامٌ فِي يَوْمٍ ذِي مَسْغَبَةٍ يَتِيمًا ذَا مَقْرَبَةٍ أَوْ مِسْكِينًا ذَا مَتْرَبَةٍ

তবে সে বন্ধুর গিরিপথটি অতিক্রম করতে সচেষ্ট হয়নি। আর কিসে তোমাকে জানাবে, বন্ধুর গিরিপথটি কি? তা হচ্ছে দাস মুক্তকরণ। অথবা খাদ্য দান করা দুর্ভিক্ষের দিনে। এতিম আত্বীয় স্বজনকে। অথবা ধূলি মলিন মিসকীনকে। (সূরা আল-বালাদ: ১১-১৬)

প্রিয় মুসলিম! এতিম প্রতিপালন নি:সন্দেহ এমন কাজ যার দ্বারা দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতের যাবতীয় কল্যাণ সাধন করা যায়। সন্তুষ্টি পাওয়া যায় মহা মহিম আল্লাহ তাআলার। তাই আমাদের সকলের ঈমানি ও নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে এ বিষয়ে সচেষ্ট হয়ে উভয় জগতের সফলতা অর্জন করা। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁর সন্তুষ্টি অনুযায়ী সকল কাজ সম্পাদন করার তাওফিক দিন। আমিন।

জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের (নারী ও পুরুষ) উপর ফরজ । জ্ঞানের শহর হলেন হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) আর সেই শহরের দরজা হলেন হজরত আলী (রাঃ) । জ্ঞান ব্যতীত কর্ম অর্থহীন আবার কর্ম ব্যতীত জ্ঞান অর্থহীন। জ্ঞানী হও তবে অহংকারী হইও না, ইবাদত কর তবে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে করোনা ।